চট্টগ্রামে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা ও বৃহস্পতিবার রাতে পটিয়া উপজেলায় এই হামলার ঘটনা ঘটে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বেলা দুইটার দিকে নগরের কোতোয়ালি মোড় হয়ে একটি মিছিল পাথরঘাটার দিকে যায়। একপর্যায়ে মিছিল থেকে কিছু ব্যক্তি হরেশ্চন্দ্র মুন্সেফ লেনের শান্তন্বেশ্বরী মাতৃমন্দিরের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর নিচতলার শনি মন্দিরের কাচ ভাঙচুরের পাশাপাশি পাথর ছুড়তে থাকে তারা। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ঘটনাস্থলে থাকা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দুপুরে মিছিল থেকে কিছু লোক পাথরঘাটায় ঢুকে পড়ে। তারা হরেশ্চন্দ্র মুন্সেফ লেনের মন্দির লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ এবং ভাঙচুরের চেষ্টা করে। আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম। পেছন পেছন এসে ঠেকানোর চেষ্টা করি। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর আরও সদস্য এলে তারা চলে যায়।’
এদিকে পটিয়া উপজেলার ছনহরা এলাকায় বাসুদেব দত্ত মুকুন্দ দত্ত ধাম ইসকন মন্দিরে বৃহস্পতিবার রাতে দুর্বৃত্তরা ভাঙচুর চালায়।
পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজমুন নূর প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে বা কারা মন্দিরের ফটকের তালা ভেঙেছে। এ সময় সিসি ক্যামেরার লাইন কাটা ছিল।’
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে হামলা
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ইসকন পরিচালিত শ্রীশ্রী হরেকৃষ্ণ নামহট্ট সংঘে হামলার ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার বিকেল পাঁচটার দিকে পৌর শহরের রানীরবাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, লাঠি হাতে কিছু মানুষ এসে হামলা চালিয়ে দ্রুত চলে যায়। এ সময় সেখানে কেউ ছিলেন না।
স্থানীয় লোকজন জানান, রানীরবাজার এলাকায় একটি ভবনের নিচতলায় শ্রীশ্রী হরেকৃষ্ণ নামহট্ট সংঘ অবস্থিত। সেখানে প্রতি রোববার প্রার্থনা ও কীর্তন হয়। রোববার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে সংঘটির কার্যালয় খুব বেশি খোলা হয় না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেলে কিছু মানুষ সংঘটির কাছে এসে স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁদের প্রায় সবার হাতে লাঠি ছিল। পরে কিছু ব্যক্তি হামলা চালিয়ে আসবাব ও ছবির ফ্রেম ভাঙচুর করেন।
সংঘটির সদস্য চন্দন পাল বলেন, কারা হামলা চালিয়েছেন, তাঁরা জানেন না। তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শবনম শারমিন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহিন। এ ছাড়া সেনাবাহিনী ও র্যাবের সদস্যরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
ইউএনও শবনম শারমিন বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর
চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটা এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তিনটি মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে নগরীর পাথরঘাটার হরিশ চন্দ্র মুন্সেফ লেইনে শান্তনেশ্বরী মাতৃমন্দির, সংলগ্ন শনি মন্দির ও শান্তনেশ্বরী কালী বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে বলে মন্দির পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য।
তারা বলছেন, কয়েকশ লোক বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে মন্দির লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে এবং শনি মন্দিরে ভাঙচুর করে। অন্য দুই মন্দিরের ফটক ভাঙচুর করা হয়।
তবে পুলিশ বলছে, দুইপক্ষের ইটপাটকেল নিক্ষেপের পর একটি মন্দিরের ‘সামান্য’ ক্ষতি হয়েছে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

শান্তনেশ্বরী মূল মন্দির পরিচালনা কমিটির স্থায়ী সদস্য এবং হরিশ চন্দ্র মুন্সেফ লেইনের সর্দার তপন দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুরে নামাজের পর কয়েকশ লোকের একটা মিছিল আসে। এসময় তারা হিন্দু ও ইসকনবিরোধী শ্লোগান দিতে থাকে।
“মিছিল থেকে দুর্বৃত্তরা শান্তনেশ্বরী মন্দিরের মূল ফটকের গেইটে আঘাত করতে থাকে, কোপায় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এসময় তারা শনি মন্দিরে ভাঙচুর চালায় এবং রক্ষা কালী মন্দিরেও হামলা চালায়। আশপাশের কয়েকটি দোকনেও হামলা হয়।”

সর্দার তপন দাশ বলেন, “অমাদের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ফোন দিলে দ্রুত তারা সেখানে আসে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
“দুপুরের আগে থেকেই মূল মন্দির এবং অন্য দুটি মন্দিরের সব ফটক বন্ধ করা ছিল। কোনো কারণ ছাড়াই মিছিল করে এসে এ হামলা চালানো হয়।”
কোতোয়ালি থানার ওসি আবদুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্বৃত্তরা এসে মন্দিরে হামলার চেষ্টা করে। উভয়পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ হয়। এসময় দুর্বৃত্তরা ছোট একটি মন্দিরে হামলা করে। পুলিশ উভয়পক্ষের মাঝখানে থেকে পরিস্থিতি নিয়স্ত্রণে আনে।”
বর্তমানে ওই এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানান ওসি আবদুল করিম।

প্রেক্ষাপট
সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধসহ আট দফা দাবি আদায়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসা চট্টগ্রাম পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে সোমবার ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
চিন্ময় দাশ বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র। তাকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। মঙ্গলবার সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলায় চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়।
আদালত চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। তাকে কারাগারে নেওয়ার সময়ও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। সমর্থকরা আড়াই ঘণ্টা আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময়ের প্রিজন ভ্যান আটকে রাখে। পরে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে তাদের সরায়।
ওইদিন বিক্ষোভকারীরা আদালত সড়কে রাখা বেশ কিছু মোটরসাইকেল ও যানবাহন ভাঙচুর করে। এরপর আদালতের সাধারণ আইনজীবী ও কর্মচারীরা মিলে তাদের ধাওয়া করে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে রঙ্গম কনভেনশন হল সড়কে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন।

তখন থেকেই চট্টগ্রামে এক ধরনের উত্তেজনার পরিবেশ চলছে, যদিও সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সবাইকে শান্ত থেকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
ওই ঘটনার পর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকন নিষিদ্ধ ঘোষণারও দাবি তুলেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠন। এমনকি বিষয়টি আদালতেও গড়িয়েছে।
আদালত সেররকম কোনো নির্দেশনা দেয়নি। আর ইসকন দাবি করেছে, আইনজীবী হত্যা এবং সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের আন্দোলনের সঙ্গে ইসকনের কেনো ‘সম্পৃক্ততা নেই’। চট্টগ্রামের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনার জন্য ইসকন বাংলাদেশকে ‘অন্যায়ভাবে দায়ী’ করার ‘অপচেষ্টা’ চলছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন